মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে কেন??

 


কেন মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামছেন তরুণ শিক্ষকরা? ভেতরের গল্প

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি নীরব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে: বহু তরুণ, শিক্ষিত ও পরিশ্রমী মাদ্রাসা শিক্ষক তাদের শিক্ষাকতার চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিচ্ছেন। কেউ বেছে নিচ্ছেন অনলাইন ব্যবসা, কেউবা যুক্ত হচ্ছেন ভিন্ন ধরনের উদ্যোক্তা কার্যক্রমে। সাধারণ মানুষের ধারণা, হয়তো তারা জাগতিক লোভ বা দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, অনেক শিক্ষকের কাছেই এই সিদ্ধান্ত বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে নেওয়া একটি পদক্ষেপ।

গভীরভাবে শিক্ষকদের সাথে কথা বলে ও তাদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করে যে মূল কারণগুলো সামনে আসে, তা সত্যিই চিন্তার উদ্রেক ঘটায়।

১. বেতনের বাস্তবতা: ১৫ হাজার টাকার চ্যালেঞ্জ

মাদ্রাসার তরুণ শিক্ষকদের চাকরি ছাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ও প্রাথমিক কারণটি হলো বেতনের বাস্তবতা।

অধিকাংশ মাদ্রাসায় একজন তরুণ শিক্ষকের মাসিক বেতন সাধারণত ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই অংকের বেতন দিয়ে একটি পরিবার পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব।ঈ

 * আকাশছোঁয়া জীবনযাত্রার ব্যয়: চাল, ডাল, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল, চিকিৎসা ও সন্তানের শিক্ষাব্যয়—সবকিছুর দাম যখন ক্রমাগত বাড়ছে, তখন ১৫ হাজার টাকার মতো সীমিত আয় নিয়ে সংসার চালানো মানেই প্রতিদিন নতুন করে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তার বোঝা কাঁধে নেওয়া। একজন শিক্ষক দিনের পর দিন এই মানসিক চাপ বহন করতে পারেন না।

 * বেতন অনিয়মিত হওয়া: কষ্টের বেতনটুকুও অনেক মাদ্রাসায় মাস শেষে সময়মতো দেওয়া হয় না। দুই থেকে তিন মাস বেতন বকেয়া থাকাটা যেন এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। অথচ এই সময়টায় শিক্ষকের পরিবারকে ধারদেনা করে চলতে হয়।

 * অর্থনৈতিক বৈষম্য: প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়, মাদ্রাসার মুহতামিম (পরিচালক) সাহেবরা দামী গাড়ি ব্যবহার করছেন, প্রভাবশালী মহলে তাদের উপস্থিতি এবং জীবনযাত্রার মানও বেশ উন্নত। অন্যদিকে, যারা মাদ্রাসার মূল ভিত্তি—সেই শিক্ষকদের প্রাপ্য টাকা পরিশোধের বিষয়টি তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। এই বৈষম্য শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও বঞ্চনার জন্ম দেয়।

২. ছুটির সীমাবদ্ধতা: যন্ত্র নয়, মানুষ চাই

শিক্ষকতার পেশায় মানবিক দিকের প্রতি অবহেলা শিক্ষকদের মনঃকষ্টের আরেকটি বড় কারণ। অনেক মাদ্রাসায় শিক্ষকদের জন্য স্বাভাবিক সামাজিক ও পারিবারিক জীবন যাপনের সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়।

 * অত্যন্ত স্বল্প ছুটি: বেশিরভাগ মাদ্রাসায় প্রতি দুই সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত একটি স্বল্প সময়ের ছুটি দেওয়া হয়। এইটুকু সময়ে বাড়ি যাওয়া, পরিবারের সাথে সময় কাটানো বা ব্যক্তিগত কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

 * জরুরি প্রয়োজনেও ছুটি না মেলা: কোনো শিক্ষক অসুস্থ হলেও, অথবা পরিবারে কোনো জরুরি সমস্যা দেখা দিলেও সহজে ছুটি মঞ্জুর করা হয় না। মনে করা হয় যেন শিক্ষকরা রক্ত-মাংসের মানুষ নন, বরং মাদ্রাসার কার্য পরিচালনার জন্য স্থাপিত যন্ত্রবিশেষ।

 * সর্বক্ষণ মাদ্রাসায় থাকার বাধ্যবাধকতা: অনেক জায়গায় নিয়ম থাকে যে শিক্ষকদের মাদ্রাসার আশেপাশে বাসা নেওয়া যাবে না, বরং অলটাইম মাদ্রাসার ভেতরেই থাকতে হবে। এই নিয়ম শিক্ষকদের ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক মেলামেশা এবং পরিবারকে সময় দেওয়ার অধিকারকে পুরোপুরি কেড়ে নেয়, যা একজন তরুণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও দম বন্ধ করা পরিবেশ তৈরি করে।

৩. মূল্যায়নের অভাব ও আত্মসম্মানহানি

সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে শিক্ষকদের মূল্যায়নের অভাব এবং আত্মসম্মানহানি।

 * কর্তৃপক্ষের 'ব্যবসায়িক' দৃষ্টিভঙ্গি: দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি 'সেবামূলক প্রতিষ্ঠান' হিসেবে না দেখে 'ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান' হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে:

   * মুহতামিম/পরিচালক: সফল ব্যবসায়ী (মালিক)।

   * শিক্ষক/কর্মচারী (উস্তাদ): সাধারণ সেলার বা কর্মচারী।

   * ছাত্র ও অভিভাবক: মাদ্রাসার কাস্টমার বা গ্রাহক।

 * শিক্ষককে তুচ্ছ করা: এই 'কাস্টমার-সেলার' মানসিকতার কারণে একজন ছাত্র বা তার অভিভাবককে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যতটা সম্মান, যতটা গুরুত্ব দেয়, একজন উস্তাদকে তার অর্ধেকটাও দেওয়া হয় না।

 * প্রকাশ্যে অপমান: সবচেয়ে অপমানজনক ঘটনা ঘটে যখন ছাত্র বা তাদের অভিভাবকের সামনেই কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে উস্তাদকে অপমান করা হয় বা হেয় করা হয়। যে মানুষগুলো তাদের জ্ঞান, সময় ও শ্রম দিয়ে একটি প্রজন্মকে ইসলামের পথে শিক্ষা দিচ্ছেন, সেই মানুষগুলোর আত্মমর্যাদা যখন বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

ফলাফল: স্বস্তির সন্ধানে নতুন পথ

বেতনের দুশ্চিন্তা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, মানবিক অধিকারের অভাব এবং সবচেয়ে বড় কথা আত্মসম্মান হারানোর যন্ত্রণা—এই সবকিছুর সম্মিলিত ফলাফল হলো মন ভাঙা একদল শিক্ষক। তারা ভাবতে বাধ্য হন, যেখানে তার সম্মান ও প্রাপ্যটুকুও নিশ্চিত নয়, সেখানে অন্তত নিজের পরিবারটিকে তো অর্থনৈতিকভাবে একটু স্বস্তিতে রাখা প্রয়োজন।

এই অর্থনৈতিক ও আত্মমর্যাদাজনিত বাধ্যবাধকতা থেকেই তরুণ, শিক্ষিত মাদ্রাসা শিক্ষকরা বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করেন। তারা তাদের মেধা, পরিশ্রম ও সততাকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিচ্ছেন—সেটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই হোক বা অন্য কোনো উপায়ে। তাদের লক্ষ্য একটিই: পরিবারকে স্বস্তি দেওয়া এবং সম্মানের সাথে জীবন যাপন করা।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মসজিদ কমিটির সভাপতি হবেন ডিসি ও ইউএনও: ধর্ম উপদেষ্টা

থালাবাটির বেদনা – গাজার পথে পথে হাহাকার আর নীরব মানবতা

ঢাকার উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত

জাতীয় সমাবেশে ৭ দফার দাবির বার্তা পৌঁছাতে চায় জামাত

এআইয়ের বাপ চলে আসলো — গুগলের NotebookLM-এর বিস্ময়কর ক্ষমতা

দখলদারদের বর্বর অভিযান: বাড়িঘর ধ্বংস, ১২ নিরীহ ফিলিস্তিনি গ্রেফতার

পরীক্ষার ফি বণ্টনের ন্যায়সংগত পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত?

গাজায় সাহায্যপ্রার্থী নিরীহ মানুষের ওপর হামলা, ইসরায়েলের ‘গাজা দখলের পরিকল্পনা’ প্রকাশ

AI প্রযুক্তির অন্ধকার দিক: ১৫টি ভয়াবহ ক্ষতি যা আপনার জানা দরকার

🌹🌹আমার হৃদয়ের কবিতা 🌹